নিজস্ব প্রতিবেদক:
আবদুল কাহার আকন্দ, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদানকারী এক তরুণ সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই), যিনি পুলিশের শীর্ষ পদে ওঠার আগে দীর্ঘ ৪৭ বছরের ক্যারিয়ারে বহু রাজনৈতিক মামলা তদন্ত করেছেন। বিশেষত, বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেলহত্যা, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, বিডিআর বিদ্রোহসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কাহার আকন্দের ক্যারিয়ারের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল শেখ হাসিনার প্রতি তার আনুগত্য এবং তার সরকারের রাজনৈতিক মিশন বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করা। শেখ হাসিনার নির্দেশে এসব তদন্তের মাধ্যমে তিনি সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত হন, যার ফলস্বরূপ তিনি পুলিশের সর্বোচ্চ পাঁচটি পদক – বিপিএম ও পিপিএম – অর্জন করেন।
পুলিশ বাহিনীতে তার প্রাথমিক পদোন্নতি ছিল ধাপে ধাপে, সিআইডি (অপরাধ তদন্ত বিভাগ) থেকে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও পরবর্তীতে পুলিশ সুপার এবং অতিরিক্ত ডিআইজি পর্যন্ত। ১৯৯৬ সালের পর যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, কাহার আকন্দ তার ক্যারিয়ারের একটি নতুন উত্থান দেখেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা এবং জেলহত্যা মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান, যা তাকে পুলিশের শীর্ষ স্তরে পৌঁছাতে সহায়তা করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফেরায়, কাহার আকন্দ চাকরিতে পুনঃবহাল হন এবং পরবর্তীতে ২০০৯ সালে সিআইডি-তে চুক্তিতে বিশেষ পুলিশ সুপার হিসেবে নিয়োগ পান। ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তেও তার ভূমিকা ছিল অতিপ্রয়োজনীয়।
২০১৯ সালে পুলিশের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর কাহার আকন্দ রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসনে সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভ করেন। তবে নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন এবং তাঁর মনোনয়ন নিয়ে তুমুল আলোচনা সৃষ্টি হয়। এরপর, এলাকাতে গুঞ্জন ওঠে যে, তিনি মন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। নিজেও আশা করেছিলেন যে, শেখ হাসিনা তাকে মন্ত্রীর দায়িত্ব দেবেন।
কিন্তু ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়ে। কিশোরগঞ্জ ও কটিয়াদী থানায় তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা দায়ের হয় এবং সেসব মামলার কারণে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। ৬ই আগস্ট, বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানা যায় যে, তিনি নিরাপদে দেশ ছাড়েন, যদিও অনেকেই মনে করেন, তিনি দেশে কোথাও আত্মগোপন করেছেন।
কাহার আকন্দের জীবন ছিল এক অভাবনীয় উত্থান ও পতনের গল্প। একজন দরিদ্র কৃষক পরিবারের সন্তান, কাহার আকন্দের জন্ম কটিয়াদী উপজেলার সহশ্রাম ধূলদিয়া ইউনিয়নের পূর্বপুরুড়া গ্রামে। তার বাবা মেহেদি আকন্দ ছিলেন একজন সাধারণ কৃষক। ছোটবেলায় তিনি অনেকটা সংগ্রাম করে পড়াশোনা করেছেন, মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তারপর ১৯৭২ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। পুলিশের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করতে করতে তিনি শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছান।
তবে কাহার আকন্দের সম্পদের আয়ের উৎস নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে। তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট ও বাড়ি করেছেন। শুধু তা-ই নয়, কানাডাতেও একাধিক সম্পত্তি গড়েছেন। তার ভাই, আবুল কাশেম আকন্দ, যিনি স্থানীয় ধূলদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, তাকেও অনেক সম্পদ গড়তে দেখা গেছে।
বর্তমানে, কাহার আকন্দের ভবিষ্যৎ ও অবস্থান সম্পর্কে নানা মতপার্থক্য রয়েছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন তিনি এখনো দেশে গোপনে আছেন, আবার কিছু সূত্র দাবি করছে যে, তিনি বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে তার রাজনৈতিক উত্থান, পুলিশ বাহিনীতে সাফল্য, এবং বিতর্কিত পতন বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসনের ইতিহাসে একটি আলোচিত অধ্যায় হয়ে থাকবে।