সাহিত্য,সংস্কৃতি,বিনোদনকে পূর্ণতা দিতে মসূয়া জমিদার বাড়ির অবদান বাংলার ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। বাংলার সাহিত্য ও চলচ্চিত্রকে যারা পূর্ণতা দিয়েছেন তাদের মধ্যে অনতম একজন হলেন অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যাজিৎ রায়। সত্যাজিৎ রায়ের জন্ম কলকাতায়। তবে তার আদি পুরুষদের পায়ের স্মৃতিচিহ্ন এখনো লেগে আছে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামের ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়িতে। বাড়িটির প্রবেশ মুখেই মিলবে রায় পরিবারের তৎকালীন জমিদারিত্বের ছাপ। বর্তমানে বাড়িটি বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতাধীন ‘সংরক্ষিত পুরাকীর্তি’ হিসেবে রয়েছে।
যদিও এই বাড়িতে কখনোই আসেননি কালজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যাজিৎ রায়। তবে এখানে স্থায়ীভাবেই বসবাস করতেন সত্যাজিৎ রায়ের প্রপিতামহ বিশিষ্ট ছড়াকার ও কথাসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর এবং তার দাদা সারদারঞ্জন রায়। ওই বাড়ির সামনে বিলবোর্ডে সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক বাড়ি লেখা হলেও গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে সেটি পরিচিত ‘জমিদার বাড়ি’ হিসাবে।
সাহিত্য,চলচ্চিত্র ছাড়াও এই বাড়িটি নানা ইতিহাস বহন করে আসছে। প্রচলিত আছে তৎকালীন জমিদার সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সহ চার ভাইকে নিয়ে জমিদার বাড়িতে ক্রিকেট ক্লাব গড়েছিলেন। ধারণা করা হয় উপমহাদেশের ক্রিকেটের অগ্রদূত ছিলেন সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী।লোকমুখে প্রচলিত আছে তার হাত ধরেই উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট খেলার প্রচলন ঘটে।
তৎকালীন সময়ে মসূয়া এলাকার জমিদার ছিলেন হরিকিশোর রায় চৌধুরী। সেসময় প্রায় সাড়ে ৪ একর জায়গা বিস্তৃত সেই জমিদার বাড়ির সিংহভাগ বিলীন হয়ে গেছে কালের গর্ভে। সময়ের সাথে সাথে হারাতে থাকে জমিদার বাড়িটির দালান-কোঠার অস্তিত্ব। ছাদের অধিকাংশ না থাকায় বাড়িটি প্রায় ধ্বংসের মুখে পড়তে যাচ্ছিলো। ফলে শঙ্কা করা হচ্ছিলো এই অবস্থায় পড়ে থাকলে বাড়িটি তার সৌন্দর্য হারাবে। দেশ বিদেশের পর্যটকদের নজরকাড়া বাড়িটি অকালেই বিলীন হয়ে যাবে।
বাড়ির প্রবেশ মুখেই রয়েছে তখনকার জমিদারদের তৈরি বিশালাকৃতির বড় পুকুর। যেটি ‘শান বাঁধাই’ ঘাট হিসেবে পরিচিত। চারপাশের ময়লা আবর্জনা এবং অব্যাবস্থাপনায় পুকুরটি বর্তমানে নর্দমায় রূপ নিয়েছে। পুকুরের উপরেই রয়েছে বিশালাকার গাছ। যেখানে বসে আলাপচারিতায় মেতে থাকতেন তৎকালীন জমিদার পরিবার।
তবে দুই মাস আগে বাংলাদেশ সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতাধীন বাড়িটি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এখন বাড়িটির সংস্কার পুরোপুরি এগিয়ে চলছে। কারিগরদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় দেওয়ালের গায়ে ফিরছে সেই প্রাচীন জমিদারি সময়ে গড়ে ওঠা বাড়টির আসল রূপ।
বাড়ির ধসে যাওয়া ছাদের উপর এখন দেওয়া হচ্ছে মজবুত কাঠের ঢিপি। সেই সাথে ভেঙে যাওয়া দেওয়ালে সেই কারুকার্য বা নকশা ঠিক রেখে নতুন ইট দিয়ে দেওয়াল সংস্কার করা হচ্ছে।
বাড়িটির পাশেই বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের উদ্যোগে ২০১২ সালে ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি অতিথিশালাসহ বাড়ির সীমানা প্রাচীর ও রাস্তাঘাট সংস্কার করা হয়েছিলো। অতিথিশালা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি ফলে দূর-দূরান্ত থেকে আগত পর্যটকদের সেই অতিথিশালায় থাকার সুযোগ মেলেনি।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, মসূয়া জমিদার বাড়িটি মসূয়া তথা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য বহন করে। বাড়িটির ইতিহাস-ঐতিহ্য পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে বাড়িটির অস্তিত্ব ধরে রাখা ছিলো সময়ের দাবী। সরকারের এমন উদ্যোগকে ধন্যবাদ জানিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।