কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার ঈদগাহ ময়দানে জঙ্গি হামলার ৮ বছর পূর্ণ হলেও শেষ হয়নি বিচারকাজ। এখনো বিচারের অপেক্ষায় আছেন নিহতদের স্বজনরা। জঙ্গি হামলার ঘটনা আজও ভুলতে পারেনি কিশোরগঞ্জবাসী। স্বজন হারানোর দুঃসহ স্মৃতি আর দেশ কাঁপানো বীভৎস ঘটনা আজও তাড়িয়ে বেড়ায় স্থানীয়দের। আশপাশের বাড়ি-ঘরের দেয়ালগুলোতে এখনো যেন আবছা হয়ে ফুটে ওঠে গুলির চিহ্ন।
২০১৬ সালে এই দিনে (৭ জুলাই) শোলাকিয়া ঈদগাহের অদূরে আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের কাছে জঙ্গি হামলা করে নব্য জেএমবির সদস্যরা। এ ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় বিচারিক আদালতে পাঁচ জঙ্গি মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, রাজিব গান্ধী, আব্দুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ, আনোয়ার হোসেন ও জাহিদুল হক তানিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
জঙ্গি মিজান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবপুর উপজেলার হাজারদিঘা গ্রামের মৃত হোসেন আলীর ছেলে, রাজিব গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার পশ্চিম রাঘবপুর ভূতমারা গ্রামের মৃত মাওলানা ওসমান গণির ছেলে, সোহেল মাহফুজ কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালীর সাদপুর কাতলিপাড়া গ্রামের রেজাউল করিমের ছেলে, আনোয়ার গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার পান্থাপাড়া গ্রামের মৃত হাকিম উদ্দিন আকন্দের ছেলে এবং তানিম কিশোরগঞ্জ শহরের পশ্চিম তারাপাশা এলাকার আব্দুস সাত্তারের ছেলে।
এর আগে, ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসবিরোধী আইনে বিচারিক আদালতে পুলিশ শোলাকিয়ার হামলা মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করে। এ জঙ্গি হামলায় ২৪ জনের সম্পৃক্ততার কথা ওঠে এলেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকায় ১৯ জন ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ায় অভিযোগপত্রে আসামির তালিকা থেকে তাদের বাদ দেওয়া হয়।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, সিরিয়া, সৌদি আরব ও পাকিস্তান থেকে হুন্ডির মাধ্যমে শোলাকিয়া হামলায় খরচের যাবতীয় টাকা আসে। জঙ্গি বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ওই টাকা নারায়ণগঞ্জে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা তামিম আহমেদ চৌধুরীর কাছে পৌঁছে দেয়। এছাড়াও ভারত থেকে আসে অস্ত্র ও গোলাবারুদ। বড় মিজানের মাধ্যমে কিশোরগঞ্জে তামিম চৌধুরীর কাছে সেই অস্ত্র ও গোলাবারুদ পৌঁছে দেয় জঙ্গি নুরুল ইসলাম মারজান।
শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার বিষয়ে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ পৌরসভার কাছে জঙ্গি মাহফুজুর রহমান বিজয় ওরফে সুজনের ভাড়া বাসায় একটি বৈঠক হয়। এরপর ২০১৬ সালের ২৪ জুন রাজধানীতে তানভীর কাদেরীর বাসায় আবার পরিকল্পনা হয়। এ পরিকল্পনায় রাজিব গান্ধী, তামিম চৌধুরী, সারোয়ার জাহান, নুরুল ইসলাম মারজান, বাশারুজ্জামান চকলেট, তানভীর কাদেরী, খাইরুল ইসলাম ওরফে বাঁধন ওরফে পায়েল, শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল ওরফে বিমল ওরফে নাহিদ, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামীহ মোবাশ্বের ও মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
পরবর্তী সময়ে হামলার তিনদিন আগে ৪ জুলাই তিন জঙ্গি নুরুল ইসলাম মারজান, সারোয়ার জাহান ওরফে আব্দুর রহমান ও রাজিব গান্ধী মিরপুরে শেওড়াপাড়ার একটি বাসায় আরো একটি পরিকল্পনা সভা করে। ওই সভায় শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদকে হত্যা করা হবে-মর্মে সিদ্ধান্ত হয়।
পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা তামিম আহমেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) জাহিদ, ফরিদুল ইসলাম আকাশ, আবির রহমান, শরীফুল ইসলাম ওরফে শফিউল ইসলাম ও জাহিদুল হক তানিম কিশোরগঞ্জ শহরের নীলগঞ্জ রোড এলাকার ভাড়া বাসায় অবস্থান করেন। এরপর ৭ জুলাই ঈদুল ফিতরের দিন সকালে শোলাকিয়ার ইমামকে হত্যা করার জন্য জঙ্গি আবির রহমান ও শরীফুল ইসলাম ওরফে শফিউল ইসলামকে অপারেশনে পাঠিয়ে তামিম আহমেদ চৌধুরী, জাহিদ ও ফরিদুল ইসলাম আকাশ কিশোরগঞ্জ ছেড়ে চলে যায়। জঙ্গি আবির ও শরীফুল হামলার প্রস্তুতি নিয়ে সকাল পৌনে ৯টার দিকে পুলিশের চেকপোস্টে তল্লাশির মুখে পড়ে চাপাতি, বোমা ও পিস্তল নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়।
এ সময় হামলায় চেকপোস্টের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যসহ ১৪ পুলিশ সদস্য আহত হন। তাদের মধ্যে কিশোরগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে কনস্টেবল জহিরুল ইসলামের মৃত্যু হয়। এছাড়াও কনস্টেবল আনসারুল হককে ময়মনসিংহ সিএমএইচে নেয়ার পর ওইদিনই দুপুরে তারও মৃত্যু হয়।
জঙ্গি হামলার পরপরই হামলাকারী জঙ্গিদের ধরতে অভিযানে নামে পুলিশ ও র্যাব। অভিযানে জঙ্গি আবির রহমান গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জঙ্গি আবিরের বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। এছাড়াও পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের গোলাগুলির সময় শোলাকিয়ার সবুজবাগের নিজ বাসায় মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঝর্ণা রাণী ভৌমিক নামে এক গৃহবধূ মারা যান। ওই সময় র্যাবের হাতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় অপর জঙ্গি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট এলাকার শফিউল ইসলাম ধরা পড়ে। ঐ সময় কিশোরগঞ্জ শহরের পশ্চিম তারাপাশা এলাকার জাহিদুল হক তানিম নামে এক যুবকও আটক হয়। পরবর্তী সময়ে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শফিউল মারা যান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলার ঘটনায় করা মামলাটি বর্তমানে সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আদালতে বিচারাধীন। বিচার কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরে আটকে ছিল। গত বছরের ২৯ আগস্ট মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ওইদিন জেলার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলার পাঁচজন আসামিকে হাজির করা হয়েছিল।
তারা হলেন- জেএমবির শীর্ষ জঙ্গি জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, মো. সবুর খান ওরফে সোহেল, জাহেদুল হক ওরফে তানিম এবং আনোয়ার হোসেন। তাদের উপস্থিতিতে বাদীসহ সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করেন বিচারক। এ পর্যন্ত পাঁচ আসামির সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে।
কিশোরগঞ্জ আদালতের সরকারি কৌসুলি (পিপি) আবু নাসের মো. ফারুক সঞ্জু বলেন, ঘটনার সাত বছর পরে হলেও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ায় অনেকটা স্বস্তি এসেছে। এখন দ্রুত মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ করা হবে এবং দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হবে বলে আমরা আশা করছি।
নিহত ঝর্ণা ভৌমিকের স্বজন ননী গোপাল এ হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার দাবি করে জানান, এ ঘটনায় তাদের পুরো পরিবার তছনছ হয়ে গেছে। আট বছর হয়ে গেলেও এ ভয়াবহ হামলার ঘটনার ক্ষত এখনো শুকায়নি।
তিনি বলেন, আজও কানে বাজে মুহুর্মুহু সেই গুলির আওয়াজ। আমাদের পরিবার এখনো ভুলতে পারছে না সেই দুঃসহ ভয়াবহ স্মৃতি। ঝর্ণা ভৌমিকের দুই ছেলে শুভদেব ও বাসুদেবকে এই দুঃখ–কষ্ট এখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছি না স্বজন হারানোর বেদনা। তাই ঝর্ণা রাণী হত্যার দ্রুত বিচার দাবি করছি।
মামলা ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে ঘটনার বিষয়ে জানা যায়, ওই বছরের ঈদুল ফিতরের দিন নামাজ শুরুর আগমুহূর্তে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের অদূরে আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের কাছে পুলিশের তল্লাশির সময় জঙ্গিরা গ্রেনেড হামলা করে। এ সময় তাদের চাপাতির কোপে পুলিশের দুই কনস্টেবল আনছারুল হক ও জহিরুল ইসলাম মারা যান। এ সময় আরো ১২ পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে ঘটনাস্থলেই আবির রহমান নামে এক জঙ্গি নিহত হন। উভয় পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে নিজ বাসায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ঝর্ণা রাণী ভৌমিক। ওই সময় আটক করা হয় জঙ্গি শফিউল ও স্থানীয় তরুণ জাহিদুল ইসলাম ওরফে তানিমকে। এরমধ্যে শফিউল ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার ডাংরি এলাকায় র্যাবের সঙ্গে গোলাগুলিতে নিহত হন।
ঘটনার তিনদিন পর ১০ জুলাই পাকুন্দিয়া থানার সেই সময়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সামসুদ্দীন বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় একটি মামলা করেন। পুলিশ ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে আর ২৮ নভেম্বর এ মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়। এ মামলার তদন্ত শেষে মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়। এরমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানকালে ১৯ জন মারা যায়। পাঁচজন দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি।
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ বলেন, শোলাকিয়া হামলার ঘটনাটি এখন আদালতে বিচারাধীন। পুলিশের পক্ষ থেকে ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। এ মামলায় দোষীদের যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি সুনিশ্চিত হয়, সে কামনা করেন তারা।
ঘটনার সময় নিজের ঘরের ভেতরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন গৃহবধূ ঝর্ণা ভৌমিক। এখনো শোকে কাতর তার পরিবার।
নিহত ঝর্ণা ভৌমিকের ছেলে শুভদেব ভৌমিক বলেন, আমার মা আমার কাছে বসেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। মনে পড়লে এখনো ঘুম ভেঙে মাকে খুঁজি। আমি তখন ছোট ছিলাম। এমনভাবে কেউ যেন তার মা না হারায়।
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ বলেন, জঙ্গি হামলায় নিহত ও আহতদের পরিবারকে পুনর্বাসনসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সর্বোচ্চ সতর্কতার সহিত মামলাটি তদন্ত করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এ মামলায় জঙ্গিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে বলে আশা জেলা পুলিশের এ শীর্ষ কর্মকর্তার।
জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর আবু নাসের মো. ফারুক সঞ্জু জানান, দেশের অন্যান্য মামলায় এসব জঙ্গিদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ থাকায় নিরাপত্তাজনিত কারণে তাদের আদালতে হাজির করা যাচ্ছে না। প্রতি তারিখে সাক্ষীরা উপস্থিত থাকলেও থমকে আছে মামলার বিচার কার্যক্রম। আশাকরি আগামী তারিখে তাদের উপস্থিত করার ব্যবস্থা করবে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৭ জুলাই ছিল ঈদুল ফিতরের দিন। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের অদূরে আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের পাশে পুলিশের ওপর হামলা চালায় জঙ্গিরা। নির্মমভাবে চাপাতি ও কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে পুলিশের দুই কনস্টেবলকে। পরে জঙ্গিরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সময় একটি গুলি লাগে এলাকার গৃহবধূ ঝর্ণা রাণীর দেহে। সেখানেই মারা যান তিনি।
নিহত ব্যক্তিদের স্বজন ও স্থানীয় মানুষের দাবি, শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের ঐতিহ্য ও মর্যাদা রক্ষায় দ্রুত এ মামলার বিচারকার্য শেষ করে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা উচিত।